মনিরুজ্জামান,
:
দ্বীপজেলার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত মহিষের দুধের কাঁচা দধি। এটা ভোলার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে। এখানকার অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম উপাদন এটি। এ টক দধি গুড়, মিষ্টি অথবা চিনি দিয়ে খাওয়া যায়। দধি সব সামাজিক, পারিবারিক ও ঘরোয়া ভোজে থাকতেই হবে। এ ছাড়া খাবার হজমে কাঁচা দুধের দধি বাড়তি সহায়তা করায় এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।স্থাানীয়রা খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে দই খায়। দই চিড়ার সঙ্গে হালকা মুড়ি ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খাওয়া যায়। গরমের মৌসুমে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করা হয়। এ ঘোল গরমের দিনে মানবদেহকে ঠান্ডা রাখে। অনেকে কুটুম বাড়িসহ ,দূর-দূরান্তের পছন্দের মানুষের উপহার কিংবা দেশের বাইরেও প্রিয়জনদের কাছে এখানকার দধি পাঠান অনেকে।স্বাস্থ্যাবিদরা বলছেন, দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপদান রয়েছে, যা আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারি।
বোরহানউদ্দিন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রবীণ শিক্ষাবিদ আবুল কালাম বলেন, প্রায় ২০০ বছর আগে ভোলার উৎপত্তি । এখানেক্রমবর্ধমান হারে জনবসতি গড়ে ওঠে। উপার্জনের জন্য্ তারা মহিষ, গরু, ছাগল পালন শুরু করে। বিশেষ করে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারগুলো শত শত মহিষ প্রতিপালন করে। এখানে এমন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হলে দধি দিয়ে আপ্যায়ন করা বাধ্যতামুলক। শীতে হাসেঁর মাংসের সাথে টক দধি আর খেঁজুরের গুড় ভোজন রসিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় খাবার।
বোরহানউদ্দিন সরকারি আব্দুল জব্বার কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবুল কাসেম বলেন, মেঘনা-তেতুলিয়া নদীতে অনেক চর রয়েছে। বিস্তীর্ণ এসব চরাঞ্চলে লালন করা হয় শত শত মহিষ। যুগ যুগ ধরে বহু পরিবার এখানে মহিষ ও দধি বিক্রির পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। দুধ-দধির ব্যবসায়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন চরে গড়ে উঠেছে শত শত মহিষ বাথান। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এসব বাথান থেকে মণে মণে দুধ আসতে শুরু করে শহরের বাজারগুলোয়।ওখান থেকে গোয়ালরা তাদের প্রয়োজ মতো দুধ কিনে নেন।এরপর বিভিন্ন ধরণের টালিতে দুধ বসিয়ে দই প্রস্তুত করেন।
দধির কারিগর কালু,কমল,বিষ্ঞু জানান, বাপ-দাদা থেকে বংশ পরস্পরায় আমরা এ ব্যবসা করছি। তারা জানান,জয়া,সাকের ভিটা,দরুন বাজার সহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের দুধ এনে থাকি।তিনি জানান,১কেজি দুধের দধির দাম ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা বেচাকেনা হয়। দুধের দাম কমলে দধিরও দাম কমে। উপজেলার সব হাট-বাজারে দধির দোকানে বিক্রি হয় মহিষের দুধের দধি। পৌরবাজারের দধি বিক্রেতা নজরুল ইসলাম,অজুদ বেপারী,মন্নান,ইমরান বলেন, সারা দেশের মধ্যে শুধু এ অঞ্চলেই এক সময় মহিষের দুধের দধির কদর ছিল। তারা বলেন, মহিষের দুধের দধি তৈরিতে তেমন কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। শুধু কাঁচা দুধটা ছেঁকে মাটির পাত্রটি (টালি) পরিষ্কার করে তাতে দুধ ঢেলে বসিয়ে দিলেই ১৮-২০ ঘণ্টার মধ্যে দধি হয়ে যায়। তারা বলেন,খাটিঁ দুধ পাওয়া মুশকিল।ভোলার একবার খাঁিট মহিষের দধি খেলে তার স্বাদ আর ভুলতে পারবে না।
দুধ বিক্রেতা মাইনুদ্দিন জানান,প্রতিদিন ছমরউ্িদ্দন,খাজুরগাছিয়া ও শ্রীনাথ চরের বাথান থেকে ১০-১২ মন দুধ এনে উপজেলার গোয়ালদের মাঝে বিক্রয় করা হয়। প্রতি কেজি দুধ ১০০ টাকা দামে বিক্রয় করা হয়। শাহিন জানান, আজকে সিকদারের চর থেকে ৩০ কেজি দুধ আনছি। ১০০ টাকা কেজি করে ৮ জনের কাছে বিক্রয় করছি।মহিষগুলো বাচ্ছা দিবে তাই দুধের পরিমান কমছে।
নজরুল দধি ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী নজরুল,অদুদ বেপারী জানান, খাঁটি মহিষের দুধ দিয়ে দধি তৈরি হয়। এর মধ্যে কোনো ধরনের ভেজাল নেই। এ দুধ অনেক ঘন। তাই স্বাদ বেশি। এ দধিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল নেই।
মহিষ বাথানের মালিক ও গংগাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রেজাউল করিম রিয়াজ,বলেন,চরলতিফ,বয়ারচর,পাতার চরে মহিষের বাথান আছে।তার ১১১টি মহিষ আছে বলে জানান,। এ ছাড়া স্বপন চেয়ারম্যান,অহিদ সর্দার,দেলু হায়দার,কয়ছর, এর বাথান আছে।সমস্ত চরে হাজার খানেক মহিষ আছে বলে জানান। দৈনিক এখান থেকে ২৩০ থেকে ২৫০ কেজি দুধ হয়। জেলায় অনেকেই ঐতিহ্য ধারণ করে মহিষ পালন করে আসছেন, যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে এসব প্রাণির নিরাপত্তার জন্য চরে কিল্লা স্থাপণের প্রয়োজন বলে মনে করেন।
তবে উপজেলা প্রাণি সম্পদ হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন ও প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) কে,এম আসাদুজ্জামান বলেন,বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ১৩ হাজার,২শত ৯৮টি মহিষ আছে।
গ্রামীন জন উন্নয়ন সংস্থাার এসইপি প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার ডাঃ তরুন কুমার পাল জানান, কেবল মহিষ ও মহিষ বাথানিয়াদের কথা চিন্তা করে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সাথে রয়েছে বিনামূল্যে মহিষের চিকিৎসা সেবা।
পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের এসইপি প্রকল্পের আওতায় গ্রামীন জন উন্নয়ন সংস্থাা ভোলার ভেদুরিয়ার চর চটকি মারা, ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চর চন্দ্র প্রসাদ ও চরমুন্সিতে মোট তিনটি আধুনিক কিল্লা নির্মান কাজ সম্পন্ন করেন। যা ভোলাতেই প্রথম বলে জানান গ্রামীন জন উন্নয়ন সংস্থাার নির্বাহী পরিরচালক জাকির হোসেন মহিন। গুরুত্ব বিবেচনায় আরো কিল্লা নির্মান কাজটি চলমান থাকবে বলে জানান তিনি।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাইফুর রহমান বলেন, ইলিশ আর মহিষের দুধের কাঁচা দধি ভোলার ব্র্যান্ড। উপকূলের মহিষের দুধে আছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। দেশের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মহিষের দুধভিত্তিক কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতে পারে। ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যের সুনাম ছড়াতে পারে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও।